ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত—একটি রাজনৈতিক পাগলামি, যার ফল এখন ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে!

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন একতরফাভাবে ইরান পরমাণু চুক্তি (JCPOA) থেকে সরে দাঁড়ান, তখন অনেকেই একে রাজনৈতিক দৃষ্টিশক্তিহীনতা বলে আখ্যা দেন। আজ, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, সেই সিদ্ধান্ত কেবল মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করেনি, বরং সরাসরি একটি বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে—ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষই তার প্রমাণ।
ট্রাম্পের একতরফা চুক্তি প্রত্যাহার: শুরু হয়েছিল এখানেই
ওবামা প্রশাসনের আমলে করা ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি ইরানকে তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি সীমিত রাখতে বাধ্য করে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের পূর্ণ প্রবেশাধিকার দেয়। ফলে ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির পথ কার্যত রুদ্ধ হয়েছিল। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশসমূহ ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে। এই চুক্তি কেবল ইরান নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিল।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তিহীনভাবে এই চুক্তিকে “সবচেয়ে খারাপ চুক্তি” আখ্যা দিয়ে বাতিল করে এবং ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতির মাধ্যমে ইরানকে আবার কোণঠাসা করার চেষ্টা করে। এর অংশ হিসেবে আবারও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নকরণ, এমনকি সামরিক হুমকি ও সোলাইমানিকে হত্যার মতো উসকানিমূলক কাজ ঘটে। এর ফলে ইরানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ আবারও শুরু হয়, পরিদর্শন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হয় এবং চুক্তির বাইরে গিয়ে ইরান আঞ্চলিকভাবে আরও আগ্রাসী অবস্থান নেয়।
ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ: একটি বড় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব
২০২৪-২৫ সালের শুরুতে গাজায় হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হলে, আঞ্চলিক উত্তেজনা চরমে ওঠে। ইরান, যা দীর্ঘদিন ধরে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও অন্যান্য প্রতিরোধ আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত, সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকায় নামে। এপ্রিল ২০২৫-এ ইরান সরাসরি ইসরায়েলে ৩০০-র বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে—যা এই প্রথমবারের মতো দু’দেশের সরাসরি সামরিক মুখোমুখি সংঘর্ষে রূপ নেয়।
ইসরায়েল পাল্টা জবাবে সিরিয়া ও ইরানের বেশ কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা একে “অঘোষিত যুদ্ধ” বলছেন যা যে কোনো সময় পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র: অদূরদর্শী নীতির ফসল ঘরে তুলছে
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র আবারও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে, যুদ্ধজাহাজ ও ড্রোন মোতায়েন করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই পরিস্থিতি কি এড়ানো যেত না? বিশ্লেষকদের মতে, যদি ট্রাম্প চুক্তি থেকে না সরতেন, তাহলে ইরানকে এই পর্যায়ে পৌঁছাতে দিত না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
ইরান এখন পরমাণু বোমা তৈরির খুব কাছাকাছি। এমনকি যদি তারা এখনো চূড়ান্ত অস্ত্র বানিয়ে না-ও থাকে, তবু প্রযুক্তিগতভাবে তারা সেই সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তই এর মূলে।
আঞ্চলিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
এই যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের দাম বেড়েছে, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা চলছে, অভিবাসী সংকট তৈরি হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ছায়া থেকে বিশ্ব এখনো পুরোপুরি মুক্ত নয়—তার মাঝেই নতুন করে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি সবার জন্য উদ্বেগজনক।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররা আবারও বিরক্ত—একদিকে চুক্তি বাতিলের জন্য, অন্যদিকে ট্রাম্প-পুতিন ঘনিষ্ঠতার স্মৃতি মনে রেখে বর্তমান রিপাবলিকান নেতৃত্বের বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে সন্দেহ।
সমাধান কী?
১. কূটনৈতিক পুনর্গঠন: ইরানের সঙ্গে আবার আলোচনায় ফিরতে হবে। তাদের পারমাণবিক সক্ষমতা সীমিত করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ও আলোচনার সমন্বয় প্রয়োজন।
২. অঞ্চলভিত্তিক নিরাপত্তা গঠন: ইসরায়েল, ইরান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশের মধ্যে সমঝোতা ছাড়া এই অঞ্চল শান্ত হবে না।
৩. যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ভারসাম্য: নতুন প্রশাসনের উচিত রাজনৈতিক বদরাগির বদলে যুক্তিনির্ভর ও কৌশলগত কূটনীতি চালু করা।
পরিশেষে বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরানবিরোধী সিদ্ধান্ত নিছকই একধরনের বোকামি ছিল না—এটি ছিল আন্তর্জাতিক কূটনীতির কাঠামোতে এক প্রচণ্ড আঘাত। এই সিদ্ধান্তের ফলে আজ বিশ্ব এক নতুন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
রাজনীতি হঠকারিতার জায়গা নয়, বিশ্ব নেতৃত্ব মানে দায়িত্বশীলতা। এই যুদ্ধ এড়ানো যেত, যদি নেতৃত্বে থাকত সহিষ্ণুতা, কূটনৈতিক দূরদর্শিতা এবং অহংবোধহীন যুক্তিবাদ।
সম্পাদক
শাহ আহমদ, আওয়াজবিডি
July 2025
৩৭-০৫ ৭৩ স্ট্রীট, জ্যাকসন হাইটস, নিউইয়র্ক-১১৩৭২, ফোন: ৬৪৬৩০৯৬৬৬৫, সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন ইমেইল: [email protected]