logo

এক মোটরসাইকেল চালকের মৃত্যুতে যেভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে ইন্দোনেশিয়া

এক মোটরসাইকেল চালকের মৃত্যুতে যেভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে ইন্দোনেশিয়া

ছবি: সংগৃহীত

গত এক সপ্তাহে ধরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর পদক্ষেপে গত কয়েকদিনে অন্তত সাতজন বিক্ষোভকারী মারা গেছেন।

রাজধানী জাকার্তায় বিক্ষোভের শুরুটা হয়েছিল গত ২৫ আগস্ট। কিন্তু সেই বিক্ষোভ সহিংস রুপ নেয় ২৮ আগস্ট রাতে। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে ২১ বছর বয়সী একজন মোটরসাইকেল চালক পুলিশের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যান, যিনি জাকার্তায় রাইড শেয়ারিং সেবা দিতেন।

প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো এবং ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ প্রধান ওই মৃত্যুর জন্য ক্ষমা চাইলেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া থেকে থামাতে পারেননি। পশ্চিম জাভা থেকে শুরু করে বালি, লোম্বকের মতো দ্বীপ এলাকাতেও তীব্র বিক্ষোভ করছে মানুষ।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল আগে থেকেই। তবে অনেকে মনে করেন এই দফায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে পার্লামেন্ট সদস্যদের মাসিক ভাতা বাড়ানোর একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে।

এমপিদের সুবিধা বাড়ানো থেকে যেভাবে বিক্ষোভের শুরু

ইন্দোনেশিয়ার সরকার পার্লামেন্ট সদস্যদের ভাতা বাড়ানোর এক সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকে মূলত এই দফায় বিক্ষোভের শুরু হয়।

স্থানীয় গণমাধ্যমের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি মাসে ইন্দোনেশিয়ার একজন এমপি ১০ কোটি রুপিয়ার বেশি (৬১৫০ ডলার) পেয়ে থাকেন, যা ইন্দোনেশিয়ার গড় আয়ের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয় একটা বড় অংশ জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইন্দোনেশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ইভ ওয়ারবার্টন বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সামাল দিতে সরকার নিজেই যখন মিতব্যয়িতার নীতি অনুসরণ করছে এবং মানুষ অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সাথে লড়াই করছে, তখন ইন্দোনেশিয়ার ধনী, রাজনৈতিক অভিজাত গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা সেই ক্ষোভের প্রকাশ করতে রাস্তায় নেমে আসে।’

এর পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, আর্থিক অসমতার মতো বিষয়গুলোও ছিল। এই বিক্ষোভের আগুনে ঘিয়ের মতো কাজ করে মোটরসাইকেল চালক আফ্ফান কুর্নিয়াওয়ানের মৃত্যু।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাকার্তার সংসদ ভবনের কাছে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশের একটি সাঁজোয়া গাড়ি দ্রুত সরে যাওয়ার সময় ২১ বছর বয়সী আফ্ফানের মোটর সাইকেলকে চাপা দেয়। সে সময় তিনি ডেলিভারি দেওয়ার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিলেন। আফ্ফানের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট প্রাবোও তার পরিবারের সাথে দেখা করেন এবং বিচারের আশ্বাসও দেন। কিন্তু তাতে বিক্ষোভের তীব্রতা কমেনি।

দেশব্যাপী বিক্ষোভ থামাতে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাতিল করার ঘোষণা দেন রবিবার। তবে ওই সিদ্ধান্তকে অনেকে স্বাগত জানালেও অনেক বিক্ষোভকারীই মনে করেন যে এটি যথেষ্ট নয়।

অল ইন্দোনেশিয়ান স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সাবেক সমন্বয়ক হেরিয়ান্তো বলেন, ‘বিক্ষোভ যে শুধু একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে, তা নয়। এই বিক্ষোভের মূলে রয়েছে বহুদিনের বৈষম্য, দুঃশাসন আর জবাবদিহিতার অভাব। মানুষ বড় ধরনের সংস্কার আশা করে, বিশেষ করে কৃষি ও শিক্ষা খাতে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে।’

বিক্ষোভ দমনে সরকারের পদক্ষেপ

বেশ কয়েকটি প্রদেশে আঞ্চলিক আইনসভায় আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। মাকাসার শহরের স্থানীয় পার্লামেন্ট ভবনে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনায় অন্তত তিনজন মারা যায়। তারা আগুন লাগিয়ে দেওয়া ওই ভবনের ভেতরে আটকা পড়েছিলেন। এছাড়াও জাকার্তায় বিক্ষোভকারীরা স্থানীয় বেশ কয়েকজন এমপির বাসায় হামলা করে লুটপাট চালায়। ওই এমপিরা এর আগে বিক্ষোভকারীদের সম্পর্কে অসংবেদনশীল মন্তব্য করেছিলেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে।

সরকার রাজনীতিবিদদের দেওয়া সুবিধা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত জানানোর পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার আদেশ দেয়। রাষ্ট্রীয় ভবনে আগুন দেওয়া ও রাজনীতিবিদদের বাড়িতে লুটপাটের ঘটনার পর এসব নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট প্রাবোও।

এঝাড়াও চলমান এই বিক্ষোভের কারণে প্রেসিডেন্ট প্রাবোও তার চীন সফর বাতিল করেছেন। অন্যদিকে টিকটকও ইন্দোনেশিয়ায় তাদের লাইভ স্ট্রিমিং সুবিধা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। উসকানিমূলক কন্টেন্ট ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে এই পদক্ষেপ নিয়েছে টিকটক।

অনেক বিক্ষোভকারীই মনে করেন যে এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ ‘মিশ্র নীতিতে’ বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করছে।

হেরিয়ান্তো বলেন, ‘একদিকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, অন্যদিকে বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগও অব্যাহত আছে।’

প্রেসিডেন্ট প্রাবোও বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ দমনে লাইট বন্ধ করে রাখা এবং রাবার বুলেট চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এসব সিদ্ধান্তের কারণে পুলিশি নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিক্ষোভকারীরা।

পরিবর্তনের সুযোগ

এই পর্যায় থেকে বিক্ষোভ কতদূর গিয়ে দাঁড়াাবে, তা নিশ্চিত নয়। তবে এটি ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে প্রাবোওর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাবোও নির্বাচন জয়ের পথে তরুণ ভোটারদের আকর্ষণ করেছিলেন টিকটক ভিডিওর মাধ্যমে। বিক্ষোভ দমনে সেই তরুণদের ওপরই ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন করা হচ্ছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন রিপোর্টে।

প্রাবোওকে অনেক ইন্দোনেশিয়ান মনে রেখেছে সেনাশাসক সুহার্তোর জামাতা হিসেবে, যিনি দ্রুতই সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে আসীন হন। সুহার্তোর শাসনের অবসানও ঘটেছিল ছাত্র বিক্ষোভের পর। তাই কীভাবে এই বিক্ষোভ সামাল দেবেন, সেটি নিয়ে নিশ্চিতভাবে যথেষ্ট সাবধান থাকবেন প্রাবোও।

পুলিশ জাকার্তার বিভিন্ন জায়গায় চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে, সেনাবাহিনী সারা শহরে টহল কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং শহরের বিভিন্ন জায়গায় স্নাইপারও দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন সাম্প্রতিক বিক্ষোভ বড় ধরনের আন্দোলনের শুরু। অর্থনৈতিক অসমতা, বৈষম্য, দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো এতোটাই গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে তার ফলশ্রুতিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এতোটা তীব্র রূপ নিয়েছে। এই বিষয়গুলোই সাম্প্রতিক যে কোনো বিক্ষোভ থেকে এবারের আন্দোলনকে আলাদা করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অনেক বিক্ষোভকারীই মনে করছেন এবারের বিক্ষোভ ইন্দোনেশিয়ায়র সমাজ ও শাসন ব্যবস্থায় 'বড় পরিবর্তন' নিয়ে আসতে পারে। উদাহরণ হিসেবে, ১৯৯৮ সালে ছাত্রদের বিক্ষোভের জের ধরে সুহার্তোর পতনের পর ইন্দোনেশিয়ায় হওয়া সংস্কারের কথাই উল্লেখ করছেন তারা।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

September 2025

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat
1
2
3
4
5
6
7
8
9
10
11
12
13
14
15
16
17
18
19
20
21
22
23
24
25
26
27
28
29
30
logo
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহ আহমদ

৩৭-০৫ ৭৩ স্ট্রীট, জ্যাকসন হাইটস, নিউইয়র্ক-১১৩৭২, ফোন: ৬৪৬৩০৯৬৬৬৫, সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন ইমেইল: [email protected]

Copyright © all Rights Reserved.